১ ৪ ডিসেম্বর মহান শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বাঙালি জাতির মেধা ও মননের প্রতীক দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের নিধনের মর্মন্তুদ স্মৃতিঘেরা বেদনাবিধুর একটি দিন। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বরের এ হত্যাকাণ্ড ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম বর্বর ঘটনা যা বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী মানুষকে স্তম্ভিত করেছিল।
পাকিস্তান নামক অগণতান্ত্রিক এবং অবৈজ্ঞানিক রাষ্ট্র গঠনের পর থেকেই বাঙালিদের বা পূর্ব-পাকিস্তানিদের সাথে পশ্চিম-পাকিস্তানের রাষ্ট্র-যন্ত্র বৈষম্যমূলক আচরণ করতে থাকে। তারা বাঙালিদের ভাষা ও সংস্কৃতির উপর আঘাত হানে। এরই ফলশ্রুতিতে বাঙালির মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে এবং বাঙালিরা এই অবিচারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করে। এ সকল আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকতেন সমাজের সর্বস্তরের বুদ্ধিজীবীরা। তাঁরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক-ভাবে বাঙালিদের বাঙালি জাতীয়তা-বোধে উদ্বুদ্ধ করতেন। তাঁদের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলেই জনগণ ধীরে ধীরে নিজেদের দাবি ও অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে থাকে যা পরবর্তীতে তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ ২৩ বছরের পাকিস্তানি বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে দেশের আপামর জনসাধারণকে সংগঠিত করে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। জাতির পিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় পাকিস্তানের দোসর জামায়াতসহ ধর্মান্ধ কয়েকটি রাজনৈতিক দল। তারা রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠন করে হানাদারবাহিনীকে সহায়তার পাশাপাশি হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে।
শহিদ বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই বাঙালির ন্যায্য অধিকার আদায়ের দীর্ঘ সংগ্রামের পথ-পরিক্রমায় বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কারানির্যাতনও ভোগ করেছেন। তাঁদের কারো কারো সঙ্গে আলোচনা করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। বুদ্ধিজীবীদের কেউ আবার বঙ্গবন্ধুর সহপাঠীও ছিলেন।
এসব কারণে শুরু থেকেই বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টুকুতেই পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের জ্ঞানী-গুণী ও মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের হত্যা করে। ১৯৭১ এর ডিসেম্বর মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে পাকিস্তান বাহিনী যখন বুঝতে শুরু করে যে তাদের পক্ষে যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়, পাকিস্তানের পরাজয় যখন শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার; তখন তারা বাঙালি জাতিকে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামাজিকভাবে দূর্বল ও মেধা-শূন্য করে দেবার লক্ষ্যে তালিকা তৈরি করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পরিকল্পনা করে।
সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিজ নিজ গৃহ হতে তুলে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। এই পরিকল্পিত গণহত্যাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।
বন্দী অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে বিভিন্ন বধ্যভূমিতে ফেলে রাখা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি, পাওয়াও যায়নি বহু লাশ।
এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ঘাতকরা চেয়েছিল, জাতির মেরুদন্ড ভেঙে দিতে। শ্বাপদীয় জন্তুর মতো ঘাতকরা ১৪ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের পর মিরপুরের বিভিন্ন বধ্যভূমি ও রায়ের বাজারে বুদ্ধিজীবীদের হাত-পা বাঁধা, চোখ বাঁধা ক্ষতবিক্ষত লাশ দেখে মানুষ আতঙ্ক ও ক্ষোভে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ইতিহাসে এ এক জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। বুদ্ধিজীবীদেরকে নৃশংসভাবে হত্যার বিষয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘...ইহারা ডাক্তারের হৃদপিণ্ড টেনে বের করে, সাংবাদিকের হাত কেটে ফেলে, ইঞ্জিনিয়ারের মগজ বের করে হত্যা করে। এমন নৃশংভাবে মানুষ হত্যার দৃষ্টান্ত দুনিয়ার ইতিহাসে নেই। (সূত্র: ইত্তেফাক, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭২) বক্তৃতাকালে সেদিন অঝোরে কেঁদেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর আবেগময় প্রকাশকে ইত্তেফাকে তুলে ধরা হয় এভাবে, ‘...বঙ্গবন্ধু বক্তৃতার সময় তাঁহার কণ্ঠ কান্নায় স্তব্ধ হইয়া যাইতেছিল এবং গণ্ডদেশ দিয়া অফুরন্ত অশ্রুধারা বহিতেছিল।’
১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বরে ওই সব বুদ্ধিজীবীকে আমরা স্মরণ করি গভীর শোক ও শ্রদ্ধায়। এ নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিত হয় শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস। বুদ্ধিজীবী হত্যার স্মরণে ঢাকায় মিরপুরে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ডাকবিভাগ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে একটি স্মারক ডাকটিকিটের সিরিজ বের করে।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী, পাকবাহিনী ও এদেশীয় রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের হাতে প্রাণ হারান। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকঃ
• গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শনশাস্ত্র)
• মুনীর চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য)
• মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য)
• আনোয়ার পাশা (বাংলা সাহিত্য)
• আবুল খায়ের (ইতিহাস)
• জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি সাহিত্য)
• সিরাজুল হক খান (শিক্ষা)
• এ এন এম ফাইজুল মাহী (শিক্ষা)
• হুমায়ূন কবীর (ইংরেজি সাহিত্য)
• রাশিদুল হাসান (ইংরেজি সাহিত্য)
• সাজিদুল হাসান (পদার্থবিদ্যা)
• ফজলুর রহমান খান (মৃত্তিকা বিজ্ঞান)
• এন এম মনিরুজ্জামান (পরিসংখ্যান)
• এ মুকতাদির (ভূ-বিদ্যা)
• শরাফত আলী (গণিত)
• এ আর কে খাদেম (পদার্থবিদ্যা)
• অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিদ্যা)
• এম সাদেক (শিক্ষা)
• এম সাদত আলী (শিক্ষা)
• সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস)
• গিয়াসউদ্দিন আহমদ (ইতিহাস)
• রাশীদুল হাসান (ইংরেজি)
• এম মর্তুজা (চিকিৎসক)
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকঃ
• হবিবুর রহমান (গণিত বিভাগ)
• শ্রী সুখারঞ্জন সমাদ্দার (সংস্কৃত)
• মীর আবদুল কাইউম (মনোবিজ্ঞান)
চিকিৎসকঃ
• মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি (হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ)
• আব্দুল আলিম চৌধুরী (চক্ষু বিশেষজ্ঞ)
• শামসুদ্দীন আহমেদ
• হুমায়ুন কবীর
• আজহারুল হক
• সোলায়মান খান
• আয়েশা বদেরা চৌধুরী
• কসির উদ্দিন তালুকদার
• মনসুর আলী
• মোহাম্মদ মোর্তজা
• মফিজউদ্দীন খান
• জাহাঙ্গীর
• নুরুল ইমাম
• এস কে লালা
• হেমচন্দ্র বসাক
• ওবায়দুল হক
• আসাদুল হক
• মোসাব্বের আহমেদ
• আজহারুল হক (সহকারী সার্জন)
• মোহাম্মদ শফী (দন্ত চিকিৎসক)
সাংবাদিকঃ
• শহীদুল্লাহ কায়সার (সাংবাদিক)
• নিজামুদ্দীন আহমেদ (সাংবাদিক)
• সেলিনা পারভীন (সাংবাদিক)
• সিরাজুদ্দীন হোসেন (সাংবাদিক)
• আ ন ম গোলাম মুস্তফা (সাংবাদিক)
অন্যান্যঃ
• আলতাফ মাহমুদ (গীতিকার ও সুরকার)
• ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (রাজনীতিবিদ)
• রণদাপ্রসাদ সাহা (সমাজসেবক এবং দানবীর)
• যোগেশচন্দ্র ঘোষ (শিক্ষাবিদ, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক)
• জহির রায়হান (লেখক, চলচ্চিত্রকার)
• মেহেরুন্নেসা (কবি)
• আবুল কালাম আজাদ (শিক্ষাবিদ, গণিতজ্ঞ)
• নজমুল হক সরকার (আইনজীবী)
• নূতন চন্দ্র সিংহ (সমাজসেবক, আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক)
একাত্তরের ঘাতকরা দেশের যে সব বুদ্ধিজীবী হত্যা করেছে তারা ছিলেন মুক্তচিন্তার পথিক। দেশপ্রেমিক এসব বুদ্ধিজীবী স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় দেখতে চেয়েছিলেন। স্বাধীনতা লাভের কয়েকদিন আগেই তাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৭১-এর ৯ মাসে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশে যে গণহত্যা হয়েছে সেটি ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের কোথাও এ ধরনের গণহত্যা ঘটেনি। ’৭১-এর গণহত্যার একটি ভয়ঙ্কর দিক হচ্ছে তালিকা প্রস্তুত করে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা। হত্যার আগে নৃশংসতম নির্যাতন করা হয়েছিল বরেণ্য শিক্ষক, চিকিৎসক, লেখক, সাংবাদিক, কবি।ও অন্য পেশাজীবীদের।
পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দ্বারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘাতক বাহিনী ‘আলবদর’ এই বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড কার্যকর করেছিল, যার নীলনকশা প্রণয়ন করেছিলেন স্বাধীনতা বিরোধী শীর্ষ নেতৃত্ব। ঘাতকরা এই দেশে এখনও সক্রিয়। তারা চেয়েছিল একটি জাতিসত্তার
অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিতে। তাদের সামনে ছিল একটা গোপন পরিকল্পনা। বাঙালি জাতি যেন মেরুদ্ন্ড সোজা করে দাঁড়াতে না পারে । সেই লক্ষ্যে
এসব ঘাতকরা সহস্রাধিক বুদ্ধিজীবিকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করে। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে দেশকে পঙ্গু বানিয়ে পাকিস্তানি শাসক ও তাদের দোসররা এমন একটা ময়দান তৈরি করে রেখেছিল, যাতে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হলেও আবার তারা মাথা তুলতে পারে। দেশের শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পারে। যেমন ইচ্ছে তেমন করে শাসন করতে পারে। কিন্তু তাদের সামনে প্রধান বাধা হিসেবে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তাদের সে স্বপ্ন কখনোই পূরণ হওয়ার ছিল না। তাই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে তারা বুদ্ধিজীবী হত্যার ফায়দা হাসিল করে নিয়েছিল। বিষাক্ত ছোবল মারার মোক্ষম সময়ের অপেক্ষায় থাকবে এ গোষ্ঠী আজীবন। আর দেশকে পিছনের দিকে টেনে নেয়ার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাবে।
সুতরাং, নতুন প্রজন্মের স্বার্থে বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগের পাশাপাশি জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা আমৃত্যু যে চেতনা লালন করেছেন তাঁর যথাযথ বাস্তবায়ন ঘটানো জরুরি। এসব অপশক্তি যেন কোনো অবস্থায়ই রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা না পায়, এরা যেন কিছুতেই এ দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে তাও নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকে।
লেখকঃ অধ্যাপক অজয় কুমার রায়
সভাপতি, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি (বাকবিশিস), সিলেট জেলা।